Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
কান্তজীউ মন্দির
স্থান

দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পারে

কিভাবে যাওয়া যায়

দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পারে এক শান্ত নিভৃতগ্রাম কান্তনগরে এ মন্দিরটি স্থাপিত।

যোগাযোগ

0

বিস্তারিত

কান্তনগর মন্দির ইটের তৈরী অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দির। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পারে এক শান্ত নিভৃতগ্রাম কান্তনগরে এ মন্দিরটি স্থাপিত। বাংলার স্থাপত্যসমূহের মধ্যে বিখ্যাত এ মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণকি কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’যুক্ত হিন্দু মন্দিরের চুড়া হতে আদি নয়টি শিখর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নির্দশন রয়েছে এ মন্দিরে।

মন্দিরের নির্মাণ তারিখ নিয়ে যে সন্দেহ ছিল তা অপসারিত হয় মন্দিরের পূর্বকোণের ভিত্তি দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত সংস্কৃত ভাষায় লেখা কালানুক্রম জ্ঞাপক একটি শিলালিপি থেকে। সূত্র অনুযায়ী দিনাজপুরের মহারাজ প্রাণনাথ ১৭২২ সালে এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং তাঁর স্ত্রী রুকমিনির আদেশে পিতার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য মহারাজের দত্তকপুত্র মহারাজ রামনাথ ১৬৭৪ সালে (১৭৫২) মন্দিরটির নির্মাণ সম্পন্ন করেন। যা হোক, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়টি শিখর বাদে মন্দিরটির ব্যাপক পুনর্গঠন করেছিলেন।

এ জমাকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলির উপরে মোট নয়টি অলংকৃত শিখর বা রত্ন রয়েছে যা দেখে মনে হয় যেন একটি উচুঁ ভিত্তির উপর প্রকান্ড অলংকৃত রথ দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যে কোন দিক থেকেই পূজারীরা ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তিকে দেখতে পায়।

বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত। এর চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান যা ঢেউ টিন দ্বারা আচ্ছাদিত। বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারত নির্মিত হয়েছে। পাথরের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুটেরও বেশি। ধারণা করা হয়, গঙারামপুরের(দিনাজপুর) নিকট বাননগরের প্রাচীর ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্মাণ উপকরণ এনে এটি তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের দিকে উচুঁ করে তৈরী তিনটি চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরণের নকশা কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠটিকে শক্তিশালী করেছে, তাই উপরের বিরাট চূড়াটিকে এ প্রকোষ্ঠটির পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাকি আটটি অলংকৃত চূড়া নিচের দু’তলার ছাদের আটটি কোণে সংযোজন করা হয়েছিল। নিচতলার বাঁকা কার্নিস কোণগুলিতে এসে ঝুলে আছে। এর মধ্যবাগ কিছুটা উঁচু হওয়ায় ভিত্তি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছে ২৫ ফুট, যার দ্বিতীয় তলার উচ্চতা ১৫ ফুট এবং তৃতীয় তলার ৬‘-৬‘‘। নিচের চারকোণের প্রত্যেকটির সঙ্গে একটি করে ছোট প্রকোষ্ঠ রয়েছে এবং এগুলি দ্বিতীয় তলার উপরে স্থাপিত কারুকার্য খচিত অষ্টকোণাকৃতির কোণের বুরুজগুলির ভর বহন করছে। নিচতলার প্রার্থনা ঘরের চারদিকে মন্দিরে মোট চারটি আয়তাকার বারান্দা রয়েছে।

নিচতলার প্রত্যেক দিকের প্রবেশ পথে বুহু খাঁজ যুক্ত খিলান রয়েছে। সমৃদ্ধ অলংকরণ যুক্ত দুটি ইটের স্তম্ভ দ্বারা প্রতিটি খিলানকে পৃথক করা হয়েছে। নিচতলার চার প্রকোষ্ঠের বাইরে মোট ২১টি খিলান দরজা আছে, আর দ্বিতীয় তলায় এ খিলান দরজার সংখ্যা ২৭টি। ছোট হয়ে আসা তৃতীয় তলার মাত্র তিনটি প্রবেশ দরজা এবং তিনটি জানালা রয়েছে। পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে ২‘-৩‘‘প্রশস্ত সংর্কীণ সিঁড়ি পথ উপরে উঠে গিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ প্রবেশ পথ এঁকে বেঁকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় উঠে গিয়েছে।
পূজারীদের চালার বাইরে প্রধান মন্দিরের প্রায় একশগজ দূরে আগাছায় ছাওয়া একটি এক চূড়া বিশিষ্ট ছোট ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির রয়েছে। প্রচলিত ধারণা মতে মহারাজ প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে এ মন্দিরটি তৈরি করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সাময়িকভাবে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। নবরত্ন মন্দির তৈরি সমাপ্ত হলে এ মূর্তিটি এখানে স্থানান্তর করা হয়। এটি এখন একটি পরিত্যক্ত দেবালয়। এ মন্দিরটি ছিল ১৬ পার্শ্ব সম্বলিত সৌধ এবং এর উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট এবং এর দক্ষিণ দিকে প্রবেশ পথে ছিল বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান।

পোড়ামাটির অলংকরণ ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরে দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মনুষ্য মূতি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের বিস্তৃত কাহিনী এবং অসংখ্য পাত্র-পাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে।

কৃষ্ণের নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র প্রতিভাত হয়েছে। পোড়ামাটির এ শিল্পগুলির বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এত যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, বাংলার যে কোন ম্যূরাল চিত্রের চেয়ে তা অনেক উৎকৃষ্ট। কেউ যদি মন্দির দেয়ালের অলংকরণের দৃশ্য যে কোন দিক থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখেন এবং বিষয়বস্তুকে সমন্বিত করেন, তবে এর বিষয় বৈচিত্র দেখে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হবেন।মন্দিরের বাইরের দেয়ালের পোড়ামাটির অলংকরণের সাধারণ যে চিত্র, তাতে চারদিকের ভিত্তি প্যানেলের নিম্নাংশে চিত্রগুলি সমান্তরাল ভাবে চারটি প্রবেশ পত্রের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।

এ দিক থেকে ভিত্তির একটু উপরেই ক) লতা পাতার মধ্যে প্রস্ফুটিত গোলাপ এবং এর বিকল্প হিসেবে কোথাও চারটি ধাতুর পাতে ধাতব প্রলেপযুক্ত ডিজাইন খ) স্ত্তম্ভের কার্নিসে যে প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার মধ্যে সমসাময়িক সামাজিক চিত্র ও মাটির খন্ডে তৈরী অভিজাত জমিদারদের শিকারের দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে গ) উপরের সমান্তরাল প্যানেলে সূক্ষ্ম জটিল অলংকরণের মাঝে প্রস্ফুটিত গোলাপ ছিল, যা সাধারণভাবে ষাট গম্বুজ মসজিদ, বাঘা মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ ও ছোট সোনা মসজিদ প্রভৃতির গায়ে লক্ষ্য করা যায়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের অলংকরণের উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ হচ্ছে বনের ভেতর শিকার দৃশ্য,হাতি, ঘোড়া, উট সহযোগে রাজকীয় শোভাযাত্রা এবং অভিজাতদের জন্য চমৎকারভাবে তৈরী গরুর গাড়ি। তাদের গায়ে ছিল মুগল পোশাক ও অস্ত্র। সুন্দরভাবে সজ্জিত হাতি এবং ঘোড়া। এদের সঙ্গে যুক্ত রথসমূহ কারুকার্য সমৃদ্ধ ছিল। অলংকৃত পালকিতে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা নাদুস-নুদুস দেহের জমিদার, হাতে তার বিলাসী হুক্কা। হুক্কার অন্যদিকে লম্বা নল থেকে ধূঁয়ার কুন্ডুলি ছুড়ছেন। অন্যদিকে নদীর দৃশ্য রয়েছে, যেখানে লোকজনে ঠাসা সর লম্বা নৌকায় সকলে আন্দোৎসবে মগ্ন।

ছোট ছোট সৈন্যদলের গায়ে রয়েছে ইউরোপীয় পোশাক, খোলা তলোয়ার ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় তারা এগিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় ধাপের অলঙ্করণে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রণ। এখানে লৌকিকভাবে কৃষ্ণর প্রতিকৃতি তৈরী করা হয়েছে। এ পর্যায়ের পোড়ামাটির অলঙ্করণে রয়েছে দানব রাজা কংস কিশোর কৃষ্ণকে বধ করতে উদ্ধত, কৃষ্ণ কর্তৃক রাক্ষস পাতনা এবং সারস গলার দানব বাকাসুর হত্যা, গোবর্ধন পার্বতকে উপরে ফেলে কেশি হত্যা; স্বর্প দানব কালিয়াকে দমন এবং লম্বা সরু নৌকায় কৃষ্ণের আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদি। মন্দিরের দক্ষিণ মুখে কিছু বিভ্রান্তকর দৃশ্যসহ রামায়ণের কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রামায়ণের কাহিনীর চিত্র পূর্ব প্রান্তের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে পঞ্চবটীর বনে রাম চন্দ্র, সীতা ও লক্ষণের বনবাসের রুপায়ণ রয়েছে, সূর্পনখার নাকে আঘাতরত লক্ষণ, দন্ডকের বন থেকে রাবন কর্তৃক সীতা অপহরণ; রাবণের রথকে বাঁধা প্রদানে জটায়ুর ব্যর্থ প্রচেষ্টা, অশোক বনে সীতার বন্দি জীবন; কিশকিন্দিয়ার সিংহাসনের জন্য বালী এবং বানর অনুসারী সহ সুগ্রীভের যুদ্ধ। এছাড়াও আকর্ষণীয় ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাম চন্দ্রের সপ্ততলা বেদ এবং বানর অনুসারীসহ রামচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় রত ছিলেন সুগ্রীভ।
উত্তর দিকের প্রতিমূর্তিগুলির মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল কৃষ্ণ বলরাম। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কৃষ্ণের বিভিন্ন বিয়ের ছবি; গোয়ালিনী দন্ডের দু্ই মাথায় ঝোলানো শিকায় (পাটের ঝোলা) দুধ ও দৈ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। অলঙ্করণের দ্বিতীয় ধাপে একটি আকর্ষণীয় ইউরোপীয় যুদ্ধ জাহাজ খোদিত হয়েছে। এখানে সূক্ষ্ম ও বিস্তারিতভাবে দৃশ্যমান রয়েছে সৈনিক এবং কামান।

পশ্চিম দিকের পুরো অংশেই তৃতীয় ধাপের সূক্ষ্ম অলঙ্করণে কৃষ্ণ কাহিনীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এ অলঙ্করণ শেষ হয়েছে মধুরার দানব রাজা কংসকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কংসের দানবাকৃতির খুনে হাতি কবল্লপীড়ার ধ্বংস, মথুরায় কংসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে কৃষ্ণকে অংশগ্রহণে বিরত করতে না পেরে রাধার জ্ঞান হারানো। এসব চিত্রের মধ্যে দন্ডের দুই প্রান্তে ঝোলানো শিকাতে দুধ ও মাখন বহন করা গোয়ালার চিত্র খুবই আকর্ষণীয়, যা এখনও গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত দৃশ্য।

বহু খাঁজ বিশিষ্ট খিলানের স্প্যান্ড্রিলের উপরে সম্প্রসারিত প্যানেলে চমৎকারভাবে দৃশ্যমান করা হয়েছে মহাকাব্যগুলির প্রাণবন্ত যুদ্ধের দৃশ্যাবলি। এতে আরও দেখানো হয়েছে একটি বৃত্তের ভেতর নৃত্যরত রাধাকৃষ্ণের যুগলশূর্তিসহ রস-মন্ডল ও এর সাথে অন্যান্য সহায়ক মূর্তি। কুরুক্ষেত্র ও লঙ্কার প্রচন্ড যুদ্ধের দৃশ্যাবলি রুপায়নে স্থানীয় লোকশিল্পীদের কল্পনা ও প্রচুর প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটেছে।

আপাতঃদৃষ্টিতে মন্দিরের দেওয়ালে ব্যাপকভাবে পোড়ামাটির চিত্র অলঙ্করণকারী লোকশিল্পীদের অনেকেই এসেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে। তারা তাদের পরিচিত পরিবেশের প্রভাব শিল্পকর্মে প্রতিফলিত করেছেন। প্যানেলে সূক্ষ্মভাবে চিত্রায়িত দেবতাগণের আদল কখনও কখনও বিস্ময়করভাবে তাদের সমাজের পরিচিত সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মিলে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমের সম্মুখভাগের নিচের দিকের প্যানেলের পোড়ামাটির অলঙ্করণগুলির কথা বলা যেতে পারে। এখানে কৃষ্ণ গাছ থেকে নারকেল পাড়ছিলেন এবং গাছের অর্ধেক পর্যন্ত আরোহণ করা তাঁর এক সঙ্গীর হাতে এটি তুলে দিচ্ছেন এবং নিচে অপেক্ষারত অন্য সঙ্গীর হাতে সে দিচ্ছিল নারকেলটি। এটি ছিল বাংলার একটি পরিচিত দৃশ্য। এখানে দেবতাকে এ সমাজের একজন পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। কতিপয় স্বতন্ত্র ফলক চিত্রও রয়েছে যেখানে স্বভাবিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ছিল। যেমন দক্ষিণ দিকে বারান্দার ভেতর দিকে একটি ফলক রয়েছে যেখানে রাধা-কৃষ্ণ একটি হাতির ওপর নৃত্য করছেন, একই সঙ্গে বেশ দক্ষতায় ডজন খানেক মানব মূর্তিও উৎর্কীণ করা হয়েছে। উত্তর দিকের দেওয়ালে কৃষ্ণ তাঁর একজন নবপরীণিতা স্ত্রীর সঙ্গে চাঁদোয়ার নিচে কটি পিঁড়িতে (নিচু করে তৈরী কাঠের আসন) বসেছেন। নববধু লাজনম্রভাবে অবগুন্ঠন দিয়ে আছেন এবং একহাত দিয়ে ধরে আছেন নিজের মাথা। তিনি চকিত দৃষ্টি দিচ্ছেন তাঁর প্রভুর দিকে। এটি বাংলার সুপরিচিত বিয়ের দৃশ্যের প্রতিফলন। কার্ণিসে অলংকৃত বিশৃঙ্খল জনতাদের মধ্যে হাঁটু ও পেছন দিক একটি গামছা পেঁচিয়ে (কাপড়ের টুকরো) হাঁটু ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে নির্লিপ্তভাবে বসে থাকা কৃষ্ণ, এমন দৃশ্যও কেউ খুঁজে পেতে পারেন। এ ভঙ্গি বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না। তবে এ দৃশ্যের মিল পাওয়া যায় বিহারের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে।

যাহোক, কান্তজীর মন্দিরের চমৎকার পোড়ামাটির অলঙ্করণের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো যে, এতে কামদ দৃশ্যাবলির চিত্র অঙ্কন করা হয়নি, যেমনটি দেখা যায় উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরসমূহে।

কান্তজীর মন্দিরের দেওয়ালের ওপর পোড়ামাটির এ বিশাল অলঙ্করণ সে সময়ের জীব ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ ছিল এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই এ শিল্প বেড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের মতো এমন ব্যাপক উর্বর পলিময় ভূমিতে পাথরের অভাব হেতু দেশীয় ধারায় পোড়ামাটি শিল্পের বিকাশ যৌক্তিক কারণেই ঘটেছিল। আদি ঐতিহাসিক যুগে, বিশেষ করে পাল চন্দ্র বংশের আমলে যখন পাহাড়পুর, ময়নামতী, ভাসু বিহার এবং সিতাকোটে বৌদ্ধ মন্দির এবং অন্যান্য ইমারতসমূহ লতা-পাতা ও পোড়ামাটির মূর্তি দিয়ে প্রাণবন্ত ছিল, তখন থেকেই এ রুপকারক শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। এ সমস্ত পোড়ামাটির ফলক ছিল বড় আকৃতির এবং কিছুটা সেকেলে ধরণের। কিন্তু কান্তনগর মন্দিরের দেওয়াল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। শিল্পীগণ অত্যন্ত উচ্চমানের পরিশীলিত এবং পরিণত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, যেখানে সমন্বিত ধারায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অলঙ্করণ করা হয়েছিল। বিচ্ছিন্ন ধারায় প্রাচীন শিল্প ঐতিহ্যের বিপরীতে এবং কিছুটা অসংলগ্ন বিন্যাসে এ মন্দিরের শিল্পের সমন্বয় ঘটেছিল বেশ কিছু স্বতন্ত্র ফলকে এবং বিস্তৃতভাবে শিল্প প্রকরণের যে সমন্বিত রুপের প্রকাশ ঘটেছিল তার মধ্যে এক ধরণের ছন্দ লক্ষ করা যায়। এরই প্রভাবে কার্পেট ও অন্যান্য সূচী শিল্পে এ ঐশ্বর্যশালী অলঙ্করনের ব্যবহার প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়।